ডেইরী খামার ব্যবস্থাপনা

সুপ্রিয় খামারী বৃন্দ,

ডেইরী খামার শুরু করার পূর্বে কিছু বিষয় জানা থাকা খুব প্রয়োজন।তবে শুরু করার পরেও এই বিষয় গুলো গুরুত্বপূর্ন।তাই ডেইরী জগতে যে কেউ এই বিষয়গুলো জেনে নিতে পারে।

ডেইরী খামার পরিকল্পনা

ভাবছেন ডেইরী খামার করবেন, তাহলে প্রথমেই আমার সুন্দর একট পরিকল্পনা দরকার।প্রথমেই আপনি চিন্তা করেন আপনি কি ভাবে খামার করতে চাইছেন।খামার শুরু করার আগে আপনার প্রথমিক কিছু ধারনা থাকা খুব জরুরী।এই ক্ষেত্র স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষন খুব কার্যকর।ধরে নিচ্ছি আপনার খামার স্থাপনের জন্য জায়গা আছে।কিন্তু জায়গার সাথে সাথে মুলধনও প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমান।

খামার ভালভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ ও বিশ্বস্ত কর্মীর কোন বিকল্প নেই।ভাই সঠিক লোকবল আপনার নিশ্চিত করতে হবে।খামার শুরু করার আগেই আপনাকে জেনে নিতে হবে খামারী উৎপাদিত দুধ কিভাবে বাজার জাত করবেন।অর্থাৎ স্থানীয় মার্কেট যাচাই করতে হবে।তাছাড়া খামারে বৈদ্যুতিক সুযোগ সুবিধা,যাতায়ত ব্যবস্থা প্রভৃতি বিবেচনা করতে হবে।এছাড়া প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে খামারের কাজ শুরু করতে হবে।

গরুর বাসস্থানঃ

সফল ডেইরী খামারে জন্য আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত বাসস্থান খুব গুরুত্বপূর্ন বিষয়।সবচেয়ে ভাল হয় বিভিন্ন বয়সের গরুর জন্য আলাদা আলাদা ঘর তৈরি করতে পারলে।গাভীর জন্য ঘর বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।যেমন গরু খোলা রেখে পালন করলে এক ধরনের ঘর আবার বেঁধে পালন করলে ব্যবস্থাটি ভিন্ন।ধরেন আপনি দুই লাইনে বেঁধে গরু পালন করবেন এবং গরু থাকবে মুখোমুখি।সেই ক্ষেত্রে ঘরের ফ্লোরের মাপটি আমি নিচে দিলাম।

খাদ্য সরবরার রাস্তা                                       : ৪ ফুট
খাদ্য প্রদানের স্থান (ম্যানজার)                          : ২ ফুট
গাভী দাঁড়ানোর স্থান                                       : ৫  ফুট
প্রতিটি গাভী দাঁড়ানোর জন্য প্রশস্ত (পাশাপাশি) স্থান :৩ ফুট
ড্রেন বা নর্দমাঃ                                             : ১ ফুট
দোচালা ঘরের উচ্চতাঃ
মাঝখানে উভয় চালের শীর্ষদেশ              :১৪ ফুট।
দুই পাশে ঢালু অংশের উচ্চতা                :৭ ফুট
চালের ছাঁচ                                       : ২ ফুট

এটি হলো আদর্শ পরিমাপ।এই মাপে করলে মোটামুটি সুন্দর একটা খামার হবে।আপনি হয়ত ভাবছেন তাহলে খামারটি লম্বায় কতটুকু হবে।যদি প্রতি গরুর জন্য গড়ে ৩ ফুট করে পাশাপাশি স্থান লাগে তাহলে এক লাইনে ১০ টি গরু রাখলে ৩০ ফুট লাগবে আর দুই লাইন করলে ২০ টি গরুর জন্য একই স্থান লাগবে।এভাবে করে ঘর তৈরি করার পর আপনি গরু কিনার দিকে মনযোগ দিতে পারেন।ভালো গরু কিনতে হলে আপনার গরুর জাত সম্পর্কে কম বেশি ধারনা থাকতে হবে।

গাভীর জাত পরিচিতিঃ

দেশে –বিদেশ বিভিন্ন জাতের গরু পাওয়া যায় যাদের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ভাল।তবে দেশী জাতের গাভির সাথে বিদেশী ভাল জাতের গাভীর কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে যে শংকর জাতের গাভী উৎপন্ন হয় নতুন খামারীদের জন্য সেগুলো অধিক উপযোগী।বিদেশী দুধের গরুর জাতের মধ্যে রয়েছে হলেস্টেইন ফ্রিজিয়ান, জার্সি,শাহীওয়াল, সিন্ধির মত ভাল ভাল জাতের গরু।এছাড়া আরো অনেক দুধের জাতের গরু রয়েছে।এ সমস্ত জাত দেখে ভাল জাতের গাভী চিনে নিতে হবে।তবে ভাল জাতের গরু দেখে কিভাবে চিনবেন তার একটি লিংক দিলাম।এখানে বিস্তারিত পাবেন।

গরুর খাদ্যঃ

গরুর কিনার সাথে সাথেই প্রয়োজন হবে খাদ্য সরবরাহের তাই গরু কিনার আগেই খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে।এজন্য এ বিষয়ে একটি ভাল ধারনা থাকা প্রয়োজন।(বিস্তারিত)।  যে খাদ্য সরবরাহ করা হয় তার দুইটি ভাগ রয়েছে।তার এক ভাগ হল আঁশ জাতীয় আর অন্য ভাগ দানাদার খাদ্য।

খড়,ঘাস ইত্যাদি হল আঁশ জাতীয় খাদ্যের মুল উৎস ।আর কুড়া ভূষি,ভূট্ট ভাঙ্গা ইত্যাদি হল দানাদার খাদ্য।গরুকে পর্যাপ্ত পরিমানে এই সমস্ত খাওয়ানোর পাশাপাশি দিতে হবে পর্যাপ্ত পরিমান খাবার পানি।খাদ্যের প্রতিটি উপাদান সঠিক পরিমানে মিশাতে হবে যাতে শরীরে কোন পুষ্টি ঘাটতি না হয়।নিচে গাভির দৈনিক খাদ্যের একটি চার্ট দিলাম প্রয়োজনে এটি ব্যবহার করতে পারেন।অথবা আপনার সুবিধা মত একটি তৈরি করে নিতে পারেন আপনার পছন্দ মত তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে করলে সঠিক হবে।

উপাদান অনুপাত
গমের ভুষি ৫০%
চালের কুড়া ২০%
খেসারী ভাঙ্গা ১৮%
তিল খৈল ১০%
লবন ১%
খনিজ ১%
মোট ১০০%

 

ঘাস চাষঃ

খামার করতে হলে কাঁচা ঘাস লাগবেই।তাই খামারে গরু তোলার কমপক্ষে দুই মাস আগে উন্নত জাতের অধিক পুষ্টির ঘাস লাগাতে হবে।উন্নত জাতের ঘাসের মধ্যে রয়েছে। যেমনঃ পাক চং,নেপিয়ার,জার্মান,পারা ইত্যাদি। (এদের চাষ সম্পর্কে জানতে নামের উপর ক্লিক করুন)তাছাড়া এই লিংকে ক্লিক করলে আরো বিভিন্ন ঘাস সম্পর্কে জানতে পারবেন যেমন  ভূট্টা ,ইপিল ইপিল,মাস কলাই ইত্যাদি।

গরুর প্রজননঃ

সাধারনত বকনা গরু দেড় বছর বয়সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে প্রজনন উপযোগী হয়।তবে জাত ভেদে এবং আনুষাংগিক বিভিন্ন কারনে এই সময় ১৩ মাস থেকে শুরু করে ৩০ মাসও হতে পারে।প্রজনন উপযোগী হওয়ার পর নির্দিষ সময়ে তা সে জানান দেয়।এই ঘটনাকে আমর বলি গরু ডাকে আসা বা গরম হওয়া (Heat)।এই সময় গরুটিকে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন করা হয়।পরামর্শ হল প্রথম কয়েকটি “ডাক” বাদ দিয়ে গরুকে প্রজনন করানো হচ্ছে বিজ্ঞান সম্মন।(ডাকে আসার বা গরম হওয়ার কি কি লক্ষন হতে পারে তা জানতে চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।)

দুধালো গাভী প্রসবের প্রায় ৬০-৯০ দিন পর পুনয়ার ডাকে আসে।প্রসবের পর প্রথম দুই একটি “ডাক” বাদ দিয়ে প্রজনন করানো উচিত।

গর্ভবতী গাভীর যত্নঃ

প্রজননের ৩ মাস পরে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় গাভী গর্ভবতী কিনা।ধরে নিলাম গাভীটি গর্ভবতী।সেই ক্ষেত্রে আপনার বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন (বিস্তারিত)।বিশেষ করে গর্ভাবস্থার ৬ মাস পার হলে অবশ্য গাভীর খাদ্য বাড়িয়ে দিতে হবে।প্রয়োজনে অন্যান্য গরু থেকে আলাদা করতে হবে।এ সময় গাভীর শরীরে ক্যালসিয়ামের মারাত্মক ঘাটতি হতে পারে সে দিকে নজর রাখতে হবে।

বাচ্চা প্রসবের পূর্বাবস্থা এবং ব্যবস্থাপনাঃ

সাধারনত প্রজননের ২৮০ ° ১০ দিলে বাচ্চা প্রসব করে।বাচ্চা প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসলে কিছু লক্ষন দেখা যায়।যেমনঃ ওলান বড় হওয়া,বাটঁ দিয়ে ঘন দুধ আসা ইত্যাদি।এসমস্ত লক্ষন দেখা দিলে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে।

বাচ্চা প্রসবের পর গাভীর সামনে রাখতে হবে।জন্মের পর জীবানুমুক্ত ধারালো অস্ত্র দ্বারা নাভি কেটে বেঁধে দিতে হবে।বাচ্চাকে অবশ্যই শাল দুধ খাওয়াতে হবে।বাচ্চা প্রসবের সর্বোচ্চ ১২ ঘন্টার মধ্যে ফুল না পড়লে চিকিৎসকের সহযোগিতায় ফুল পরিষ্কার করতে হবে।

বাচুর পালনঃ

ভবিষ্যতে ভাল গাভী পেতে হলে বাচ্চা থেকেই সঠিক ভাবে পরিচর্যা করতে হবে।সাধারনত দেশী গরুর তুলনায় শংকর জাতের গরুর বাচুরকে যত্ন করতে হয় বেশি।বাচুরকে জন্মের পর কয়েকদিন শুষ্ক ও পরিষ্কার স্থানে বাচুরকে লালন পালন করতে হবে।চাইলে আপনি পৃথক খাঁচা করেও বাচুরকে রাখতে পারেন।

বাচুরকে জন্মের পর ৫-৭ দিন শাল দুধ খাওয়াতে হবে।পরবর্তীতে  তার ওজনের ১০-১৫% দুধ খাওয়াতে হবে দৈনিক।(বিস্তারিত)৬-৮ সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক নির্দিষ্ট সময়ে দুধ খাওয়াতে হবে।পরবর্তীতে দৈনিক দুইবারই যতেষ্ঠ কারন এ সময়ে আঁশ ও দানাদার খাদ্য খাওয়া শুরু করে।

বাচুরের সাধারনত নিয়োমোনিয়া,সাদা উদারময় কৃমি,নাভি পাকা,জ্বর,সর্দি,পাতলা পায়খানা ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসায় এই সব বিপদ কাটিয়ে উঠা যায়।

গরুর সাধারন রোগসমূহঃ

গরুর গরুর শরীরে ব্যাক্টেরিয়া,ভাইরাস,প্রোটোজোয়া,ছত্রাক,কৃমির আক্রমঅনে রোগ হতে পারে।তাছাড়া বিপাকীয় সুমস্যা কারনেও কিছু রোগ হতে পারে।

ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগের মধ্যে রয়েছে বাদলা, তড়কা,গলাফুলা,যক্কা ইত্যাদি আর ভাইরাস গঠিত রোগের মধ্যে রয়েছে ক্ষুরা রোগ,গোবসন্ত,তিন দিনের জ্বর (Ephemeral Fever) ইত্যাদি।

ছত্রাকের সংক্রমনে হতে পারে দাদ,চোয়াল ফোলা ইত্যাদি রোগ এবং প্রটোজোয়ার সংক্রমনে হতে পারে বেবিসিওসিস,থেইলেরিয়াসিস ইত্যাদি রোগ।কৃমির সংক্রমন সব গরুর মধ্যেই দেখা যাই।মারাত্মক একটি কৃমি হল কলিজা কৃমি।সেই বিষয়ে জানতে এই লিংকে ক্লিক করুন।

কিছু রোগ আছে যেগুলো ব্যাকটেরিয়া,ভাইরাস অথবা অন্য অনেক কারনে হতে পারে সেই রোগগুলো খামারীদের কষ্ট দেয় বেশি।তার মধ্যে সব চেয়ে  বেশী সমস্যা করে গাভীর ওলান প্রদাহ (Mastitis) রোগটি।(প্রতিরোধ সমপর্কে জানতে  লিংক ক্লিক করুন)।তাছাড়া ভিটামিন মিনারেলের অভাবেও কিছু মারাত্মক রোগ হয়।যেমন গাভির শরীরে ক্যালেসিয়ামের ঘাটতির কারনে একটি রোগ হয় যাকে বলা হয় মিল্ক ফিবার (Milk fever)।

টিকা প্রয়োগঃ

গরুর কয়েকটি মারাত্ম রোগ আছে যেগুলো টীকা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়।এই রকম টীকার মধ্যে আছে ক্ষুরা রোগের টীকাএন্থ্রাক্স টীকা, বাদলা রোগের টীকা,গলাফুলা রোগের টীকা।এছাড়া আরো কিছু টীকা আছে যেটা খামারের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে করবে আরো জোড়ালো।

জীব নিরাপত্তাঃ

খামার রোগ জীবানুমুক্ত রাখতে পারলে অনেক রোগ থেকে খামারকে বাচাঁনো যায়।তাই লাভজনক খামারে পূর্ব শর্ত হলো খামারকে জীবানু মুক্ত রাখা।এ ব্যাপারে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

 

সরাসরি আমাদের সাথে যুক্ত হতে চাইলে অথবা আপনার কোন কিছু জানার থাকলে www.facebook.com/farmerhope.page এ ম্যাসজ করে জানাতে পারেন।ভবিষ্যতে গুরুত্ব অনুসারে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

Farmer Hope