বাংলাদেশের ডেইরী শিল্পের স্বয়ং সম্পূর্নতা অর্জনে আমাদের করনীয়

0
881

দেহের বিকাশ ও পুষ্টি সাধনের জন্য যেসব উপদান খুব গুরুত্বপুর্ন, দুধ এসবের মধ্যে প্রধান। জন্মের ছয় মাস পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুধ মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরন করে।মানুষের বুদ্ধিমত্তা,উচ্চতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দুধের যতেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যেরও প্রয়োজন রয়েছে।তবু মানুষের মধ্যে এখনো এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির করতে পারলে দুধের সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।আর চাহিদা বৃদ্ধি পেলে এই শিল্প বিকশিত হবে। দুগ্ধ শিল্পের উন্নয়ন হলে দেশের মানুষের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে।
ইতিমধ্যে আমাদের দেশ দুগ্ধ শিল্পে বেশ বিকশিত হয়েছে। বিগত ১০ বছরে যা সবচেয়ে বেশি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০০৯ সালে যেখানে বাৎসরিক দুধের উৎপাদন ছিল ২৩.৭০ লাখ মেট্রিক টন, ২০২০ সালে তা প্রায় পাঁচগুন বৃদ্ধি পেয়ে ১০৬. ৮০ লক্ষ মেট্টিক টনে এসে পৌঁছেছে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে নিউজিল্যান্ডের খামারের মত কিছু খামার গড়ে উঠছে। যেখানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে খামারের অনেক ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে। খামারের প্রয়োজনীয় খাদ্য ব্যবস্থাপনায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম কারন হল খামারীদের ঘরে ঘরে দুধ উৎপাদনকারী জাতের দুধের গরুর আধিক্য।তবে অনেক খামারীর কাছে এখনও ভাল মানের দুধের গরু নেই।সকল খামারীদের খামারে উন্নত জাতের বেশি দুধ উৎপাদনের গাভী থাকলে দুধ উৎপাদন আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে।

উপরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ২০০৯ সালে যেখানে দুধের উৎপাদন ছিল ২০২০ সালে  এসে  তা প্রায় পাঁচ গুল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বর্তমান জনসংখ্যার অনুপাতে এই দুধও দেশের সকল মানুষের জন্য পর্যাপ্ত নয়। দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য যদি চাহিদা দৈনিক ২৫০ মিলি করে হিসাব করি তাহলেও বাৎসরিক ১৫২.০২ লক্ষ মেট্রিক টন দুধের প্রয়োজন। কিন্তু আমরা তার থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছি। কারন বর্তমানে আমাদের দেশে বার্ষিক দুধ উৎপাদনের পরিমান ১০৬.৮০ লক্ষ মেট্রিক টন।সেই হিসেবে দৈনিক দেশের প্রতিটি মানুষ গড়ে ১৭৫.৬৩ মিলি করে দুধ পায় অথচ ২০১৫ সালে প্রতি মানুষের জন্য গড়ে দৈনিক এই প্রাপ্তি ছিল ১২৫.৫৯ মিলি। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে মাথাপিছু গড়ে দৈনিক দুধ প্রাপ্তির পরিমান বেড়েছে প্রায় ৫০.০৪ মিলি।কিন্তু তাও পর্যাপ্ত নয়।এখনো মাথাপিছু দৈনিক দুধ উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৭৪.৩৭ মিলি।

এই বিশাল পরিমান দুধের চাহিদা পূরন করতে দেশে বাজারে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে আমদানিকৃত গুড়ো দুধ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশে দুধ এবং ক্রিম আমদানীর পিছনে ব্যয় হয়েছে ৩১,৯০০ মিলিয়ন টাকা যা দেশের মোট আমদানীর প্রায় ১.৩৭%(চিত্র-২)। অথচ চার বছর আগে  এই খাতে দেশের অর্থ ব্যায় হয়েছে প্রায় অর্ধেক।তবে দেশীয় ডেইরী শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে বাৎসরিক আমদানী পরিমান বৃদ্ধির হার কমেছে । এটা আমদের মনে আশা জাগায়। দুধ আমদানীতে ব্যয়িত এই বিশাল পরিমান অর্থ দেশেই রাখা যায় শুধু মাত্র দেশের ডেইরী শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে।

চিত্রঃ২ঃ দুধ এবং ক্রিম আমদানীতে ব্যয়িত অর্থের রেখ চিত্রে (তথ্যঃ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ গুড়ো দুধ আমদানী করেছে ১৫০ হাজার মেট্রিকটন (চিত্র-৩)। প্রতি বছর এই গুড়ো দুধ আমদানীর পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে।গত পাঁচ বছরে বিদেশ থেকে দুধ আমদানীর পরিমান দ্বিগুনেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে গুড়ো দুধ আমদানী করা হয়েছিল ৭১ হাজার মেট্রিকটন কিন্তু তা পাঁচ বছরের ব্যাবধানে অনেক বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০ হাজার মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। যদিও এই সময়ে দেশের ডেইরী শিল্পেও ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে দেশের আভ্যন্তরিন দুধ উৎপাদন ছিল ৬০ লক্ষ মেট্রিকটন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গিয়ে তা ১০০ লক্ষ মেট্রিকটনের কাছাকাছি হয়ে যায়।

চিত্র-৩ঃ বছর ভিত্তিক গুড়ো দুধ আমদানীর পরিমান (সুত্রঃ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)


এই বিপুল পরিমান দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পরও বিদেশ থেকে দুধ আমদানীর পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতি বছর।দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এর একটি কারন হতে পারে।তাছাড়া  দিনের পর দিন দুধের প্রতি সাধারন মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।দেশে শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির কারনে মানুষের মধ্যে দুধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্ঞানও বৃদ্ধি পাচ্ছে।দিনের পর দিন দুধের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।সাথে সাথে দেশে দুধ উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েহে। কিন্তু তারপরও বাইরে থেকে দুধের আমদানী বছরের পর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠে দেশে দুধে স্বয়ং সম্পূর্ন হতে হলে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন বেসরকারী উদ্যোগ।

ডেইরী শিল্পে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার অনেক কারন রয়েছে ।জাতীয় ডেইরী উন্নয়ন নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়ায় তার মধ্যে উল্ল্যেখ যোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হয়েছে।যেমনঃ

  • উন্নত জাতের গাভীর অভাব।
  • গো-খাদ্যের অপ্রতুলতা এবং উচ্চমূল্য।
  • মানসম্পন্ন খাদ্যের অভাব।
  • প্রান্তিক খামারীদের জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব।
  • রোগের প্রাদূর্ভাব।
  • ভ্যাক্সিনের অভাব।
  • ঔষধের উচ্চমূল্য।
  • দক্ষ জনবলের অপ্রতুলতা
  • অল্প সুদের ব্যাংক ঋনের অপ্রতুলতা।
  • উৎপাদিত দুধ বাজারজাতকরনের সমস্যা।
  • দুধের ন্যায্য মূল্যের অভাব।
  • গাভী বীমা না থাকা।
  • দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য সংরক্ষন এবং মান নিয়ন্ত্রনের সুযোগ সুবিধার প্রতুলতা।
  • নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্টান, যেমন জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড এর অভাব
  • গোচারন-ভূমির অপ্রতুলতা।

শুরু থেকেই প্রাণিসম্পদ অধিধপ্তর, প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের দুধের চাহিদা পূরনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। উপরোক্ত সমস্যা সমূহ কাটিয়ে উঠার জন্য সব চেয়ে গুরুত্বপুর্ন হল দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। দেশীয় দুধ উৎপাদনের বৃহৎ একটি অংশ আসে প্রান্তিক এবং গ্রামীন খামারীদের কাছ থেকে। যেখানে আধুনিকায়নের ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি। এই প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারীদের উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য ও এর বিকাশ সাধনে এবং জাতীয় পুষ্টিতে দুগ্ধের গুরত্বপূর্ন ভূমিকা থাকবার কারনে ‘জাতীয় ডেইরী উনয়ন নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়ায়’ দুধ উৎপাদন তথা দুগ্ধ ক্ষেত্রকে জাতীয় গুরুত্ব প্রদান করতঃ ‘জরুরী সেক্টর’ হিসেবে চিহ্নিত করার  প্রয়োজনীতার কথা বলা হয়েছে।

দেশের যে সমস্ত এলাকায় দুধ বেশী উৎপাদন হয় সেই সমস্ত এলাকায় সমবায় ভিত্তিক দুধ উৎপাদন কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন।যদিও দেশে বেশ কিছু এলাকায় এটি চালু আছে।সেক্ষেত্রে এই সমস্ত সমবায়ের কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন।এই ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের মত  তিনস্তর বিশিষ্ট সমবায় মডেল অনুসরন করা যাতে পারে।

দুধ এবং দুধ থেকে উৎপন্ন পন্যের পঁচার ঝুঁকি থাকে বেশি। তাই যাতায়তের সর্বক্ষেত্রে একে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া জরুরী শিশুখাদ্য হিসেবেও একে বিশেষ পরিবহন সুযোগ প্রদান করা প্রয়োজন।

প্রান্তিক খামারীরা অনেক সময় ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।তাই রাষ্ট্র বা সরকার সকল খামারীদের দুধ এবং দুগ্ধ জাত পন্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।এতে খামারীদের আগ্রহ বাড়বে এবং নতুন উদ্যোগতারাও আগ্রহ পাবে।তবে এ ক্ষেত্রে সরকার চাইলে দুধের উৎপাদন খরচ এবং দুধের গুরুত্বের সাথে সামঞ্জ্য রেখে ন্যায্য মূল্য নির্ধারন করে দিতে পারে।যা খামারী এবং ক্রেতা সকলের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

গ্রামীন পর্যায়ে দুধ থেকে যারা বিভিন দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন দই, মাখন, ঘি, ছানা, পনির ,মাঠা, ও বিভিন্ন জাতের মিষ্টি ইত্যাদি তৈরি করা তাদেররে প্রশিক্ষিত করে আধুনিক পদ্ধতির সাথে অভ্যস্ত করতে হবে। তাছাড়া নতুন নতুন উদ্যোগতা তৈরি করতে হবে, যাদেরকে এই সমস্ত বিষয়ে ধারনা দিতে হবে, যাতে তারা আগ্রহ বোধ করেন। কোন পদ্ধতি অনুসরন করলে দীর্ঘ সময় ধরে এই সমস্ত পন্য ভাল থাকে সেই ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে। তাছাড়া দুধ সংরক্ষন ও প্রক্রিয়াজাতকরনের জন্য বেসরকারী পর্যায়ে নতুন নতুন দুধ প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের জন্য উদ্যোগতাদেরকে উৎসাহিও করতে হবে।

দেশে দুধের উৎপাদান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজ়ন উন্নত জাতের গাভী উৎপাদন  সেই জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী উন্নতজাতের গাভীর জাত তৈরির জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করা প্রয়োজন।সাথে সাথে জাতীয় কৃত্রিম প্রজনন নীতিমালা অনুসরন করা দেশের কৃত্রিম প্রজননের কাজ আরো অনেক সম্প্রসারন করা প্রয়োজ়ন। এজন্য দেশের হিমায়িত বীজ উৎপাদন কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে সীমেন উৎপাদন আরো বাড়ানো প্রয়োজ়ন।

দেশের দুধ এবং দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে মহিষের দুধ। তাই বাংলাদেশের  আবহাওয়ার সাথে মানানসই দুধালো জাতের মহিষ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এই কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন।

দেশের দুধের উৎপাদন তথা ভাল মানের দুধের গাভী উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উন্নত জাতের ভাল মানের ঘাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা খুব প্রয়োজন। এ জন্য সরকারী পর্যায়ে প্রতিটি উপজেলায় ঘাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া‌ প্রয়োজন। তাছাড়া অপ্রচলিত গো-খাদ্য ব্যবহারে জন্য খামারীদের উৎসাহিত করতে হবে। সাথে সাথে কৃষির উপজাত হিসেবে থাকা বিভিন্ন উপাদান গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে।

খামারীদের উৎপাদিত পন্য যাতে সহজে বাজারজাত করা যায় সেই ব্যাপারে সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে খামারীদের খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দুধের দাম নির্ধারন করে  ছোট, বড়, প্রান্তিক সকল খমারীর সকল দুধ বাজারজাতকরনের ব্যবস্থা করতে হবে। দুধের দাম নির্ধারনের ক্ষেত্রে দুধের চর্বির উপর ভিত্তি করে দুধের দাম কম বেশি হবে। গ্রামাঞ্চল থেকে দুধ সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে চিলিং পয়েন্ট স্থাপনের মাধ্যমে দুধ সংরক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সব চিলিং পয়েন্ট থেকে সরাসরি শহরে বা বড় বড় সুপার শপগুলোতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।মধ্যসত্বাভোগীর সংখ্যা কমিয়ে খামারী থেকে ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

ডেইরী শিল্পের উন্নয়নের জন্য গবেষনারে বিকল্প নেই।তাই জাতীয় দুগ্ধ গবেষনা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা  যেতে পারে। সাথে সাথে দেশব্যাপী ব্যাপক সম্প্রসারন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। তাছাড়া গবাদি প্রাণির খামার ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরনের লক্ষ্যে প্রতি ইউনিয়নে দক্ষ এবং যতোপযুক্ত প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন।

গবাদি প্রাণির স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ নিয়ন্ত্রএর জন্য মানসম্পন্ন ঔষধ ও টিকা প্রাপ্তির নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশীয় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আরো আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। সাথে সাথে আঞ্চলিক যে সমস্ত রোগ নির্নয় গবেষনাগারগুলো আছে সেগুলো যুগোপযুগী করতে হবে।

ডেইরী শিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি ‘জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড’ থাকা খুব প্রয়োজন যার মাধ্যমে এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে মান নিয়ন্ত্রন ও উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।

আশার কথা হল ডেইরী সেক্টরের উন্নয়নে বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়ে লাইভষ্টক এন্ড ডেইরী ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এল,ডি,ডি,পি) প্রকল্প চালু করা হয়েছে।তাই এই প্রকল্প সফল ভাবে শেষ হলে ৬০ লাখ মেট্রিন টন দুধের যে ঘাটতি রয়েছে তা অনেকাংশে পূরন হয়ে  যাবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক খামারী শক্তিশালী করা হবে যার মধ্যে প্রায় অর্ধে হবে নারী। এখানে খামারীর গঠনগত পরিবর্তন থেকে শুরু করে, খামারের উৎপাদ প্রক্রিয়াজাতকরন এবং বিপননের উনয়ন সাধন করা হবে। ফলে দুধ বিক্রি নিয়ে খামারীরা যে মারাত্মক সমস্যায় পড়ে তা অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পারে। ফলে নতুন উদ্যোগতারা ডেইরী খামার তৈরীরে আগ্রহী হবে।

কিছু কিছু সময়ে দেশে যেসব অঞ্চলে দুধের উৎপাদন বেশি সেখানে খামারীরা ন্যায্য মূল্যে দুধ বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু দুধের সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরন এবং বিপনন করা গেলে দুধ নষ্ট হওয়ার ভয় থেকে খামারীরা বেঁচে যাবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে দুধের চিলিং পয়েন্ট স্থাপন করা হবে।বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।তাই এই প্রকল্পে দুর্যোগকালীন বিপদ মোকাবিলার জন্য খামারীদে তৈরি করা হবে।

সম্প্রতি কালে গড়ে উঠা ডেইরী বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা এবং শিক্ষিত যুব সমাজের অংশ গ্রহনের কারনে দেশে এই বিষয়ক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশে উপজেলা, জেলা এবং জাতীয় পর্যায়ে ডেইরী খামারীদের বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছে।যেখানে তালিকাভুক্ত হয়েছে লক্ষাধিক খামারী যাদের বিরাট একটা  অংশ শিক্ষিত যুব সমাজ।শিক্ষিত যুব সমাজ লেখা পড়া শেষ করে শুধু মাত্র চাকরির জন্য বসে না থেকে নিজেকে নিয়োজিত করছে ডেইরী সেক্টরে।যার ফল দেশের জনগন ইতোমধ্যে ভোগ করতে শুরু করে দিয়েছে।এই শিল্পে যুক্ত হচ্ছে শিল্পপতিরাও।দুগ্ধ শিল্পে আমরা স্বয়ং সম্পুর্নতে অর্জনের কাছাকাছি চলে এসেছি।


এই ধারা অব্যাহত থাকলে  ভবিষ্যতে আমারা দুধের ঘাটতি পুরন করে রপ্তানী করতে পারব বলে আশা করি।এজন্য সরকারী সহযোগিতার পাশাপাশী বেসরকারী উদ্যোগতাদেরকেও আরো বেশি এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
ইতোমধ্যেই বেশ কিছু বড় মাপের ডেইরী খামারি দেশে গড়ে উঠেছে যা দেশের দুধের চাহিদা পূরনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।সম্প্রতি আমরা দেখেছি সুদূর অষ্ট্রেলিয়া থেকে এক সাথে ২৫০ টি ফ্রিজিয়ান গরু এনে হাই টেক ফার্মিং শূরু করেছেন শিল্প উদ্যোগতারা। এই ধরনের উদ্যোগ ডেইরী সেক্টরে নব দিগন্তের সুচনা করবে বলে আশা করা যায়।

দুধ উৎপাদনে এগিয়ে থাকা  বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোতে এই সেক্টরে প্রচুর পরিমানে ভর্তুকি দেওয়া হয়।আমাদের দেশেও এ রকম উদ্যোগ গ্রহন করা প্রয়োজন।এর পরেও খামারীরা প্রোটিনের চাহিদা পুরনে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে। এই পরিশ্রমের ফলেই একদিন দেশ দুধে স্বয়ং সম্পূর্ন হয়ে বিদেশেও রপ্তানী করতে পারবে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমরা আমাদের কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।

  • সরকারের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে ডেইরী সেক্টরের উন্নয়নে যা ইতোমধ্যে শূরু হয়ে গেছে।
  • দেশের কৃত্রিম প্রজনন কার্য সম্প্রসারনের মাধ্যমে উন্নত জাতের অধিক দুধ উৎপাদনকারী গরুর সংখ্যা বাড়াতে হবে যাদের  পর্যাপ্ত ঘাসের ব্যবস্থা থাকবে।
  • আরো বেশি পশু খাদ্য তৈরির ফেক্টরী তৈরি করতে হবে যেখান থেকে ন্যায্য মূল্যে শুধু মাত্রে নিবন্ধিত খামারতীরা ন্যায্য মূল্যে পশুর দানাদার খাদ্য কিনতে  পারবে।
  • দেশের সকল পর্যায়ে ভেটেরিনারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
  • খামারীদের জন্য খামার ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্বল্প মেয়াদী প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং প্রকৃত খামারীদের স্বল্প মেয়াদী লোন প্রদান এবং তা নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।লোন প্রদানের ক্ষেত্রে পাবলিক এবং প্রাইভেট সেক্টরের এই সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠাঙ্গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
  • দুধের দাম একটি সহনীয় মাত্রায় রাখতে হবে যাতে করে ক্রেতা সহজে নিতে পারে এবং খামারীও লাভবান হয়।সাথে সাথে খামারীরা  যাতে সঠিকভাবে দুধ সংরক্ষন করে সঠিক ভাবে বিপনন করতে পারে সেই বিষয়ে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নিতে হবে ।প্রয়োজনে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থা,বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানি সরবরাহ এবং দুধ সংরক্ষন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।
  • দেশের ডেইরী শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য গুড়ো দুধ আমদানীকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
  • অত্যাধুনিক ডেইরী খামারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যাতে খামারীরা দেশ থেকে থেকেই সংগ্রহ করতে পারে সে জন্য স্থানীয় শিল্প উদ্যোগতাদের এগিয়ে আসতে হবে।
  • সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে নিয়মিত পর্যাপ্ত ভেক্সিন এবং ঔষধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
  • দুধের প্রয়োজনীয়তা এবং ডেইরী খামার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচুর প্রচার করতে  হবে এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

অথএব, উপরের আলোচনায় উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের সঠিক বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের যতোপযুক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে আশা করা যায় নিকট ভবিষ্যতে দেশের চাহিদা পুরন করে বিদেশে রপ্তানি হবে আমাদের দেশের দুধ এবং দুগ্ধজাত পন্য।